মধ্যবিত্তের কষ্টের গল্প | অবহেলার কষ্টের গল্প


বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প


বার্ষিক পরিক্ষা শেষ। অনেকদিন গ্রামে যাওয়া হয় না। তাই গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। আমার নানুবাড়ি গ্রামে। এজন্য গ্রামে নানুবাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সাথে আমার প্রিয় বাংলা গল্প এর বই নিয়ে নিলাম।


আমার সাথে হারুন মামাও যাবেন। হারুন মামা আমাদের পুরনো ড্রাইভার। আমাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত মানুষ।

পরদিনই আমি মামার সাথে গ্রামের বাড়ীতে বেরাতে গিয়েছিলাম। গ্রামে কয়েকদিন ভালোমতোই কাটালাম। গ্রামের মেঠোপথ, নদী-নালা ও মুক্ত পরিবেশ আমার মনকে করেছিল পুলকিত।

কয়েকদিন গ্রামে ছুটি কাটানোর পর, এবার বাড়ী ফেরার পালা। গ্রাম থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার সময় হারুন মামার ফোন এলো। মামা গাড়ি নিরাপদে দাঁড় করিয়ে ফোন ধরলেন।

ফোন ধরেই মামা থমকে গেলেন। মামার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিষাদের ছায়া। মামা কিছু বলছেন না। তার ঠোঁট কাঁপছে। তিনি কানের কাছে ফোন সেট ধরে শুধু শুনে যাচ্ছেন।

আমি দেখলাম, তার দুই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন- “আমার ছোট ভাই নীরু রোড অ্যাক্সিডেন্টে…।” বাকিটুকু তিনি আর বলতে পারলেন না। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তিনি শুধু নীরবে দাড়িয়ে রইলেন।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিছুদিন আগেই নীরু মামা আমাকে তাদের গ্রাম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামের পাশেই তাদের গ্রাম।

আমি হারুন মামাকে গাড়ি ঘোরাতে বললাম। মামা ড্রাইভিং সিটে বসে কাঁদছেন। আমি মামাকে আমার সিটে বসিয়ে, গাড়ি ঘুরিয়ে নীরু মামাদের বাড়ির দিকে চালাতে শুরু করলাম।


মিনিট দশের মধ্যে আমরা চলে এলাম। দূর থেকেই লোকজনের কান্না শুনতে পেলাম। আমি গাড়ি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। হারুন মামা আমাকে থামালেন।

আমরা দুজন নেমে গিয়ে দেখলাম, নীরু মামাকে ঘিরে মানুষের জটলা। এলাকার মেম্বারও এসেছেন।

নীরু মামার বড় ছেলে আমার বয়সী নূরুল এসে হারুন মামাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।

গ্রামের লোকজন কেউ কেউ বলতে লাগল, এত বড় সংসার, নীরুর আয়-রোজগারেই চলত । এখন কীভাবে যে চলবে সেটাই বড় সমস্যা।

হারুন মামা পকেট থেকে পাঁচশত টাকা দিয়ে একজনকে ডেকে বললেন, “যা, কাপড় নিয়ে আয়। আমি চেয়ারম্যানকে বলে বাকি বন্দোবস্ত করি।”

তখন জমির মেম্বার বললেন- “সে ব্যবস্থা করেছি হারুন ভাই। তুমি দাফন-কাফনের ব্যবস্থা কর। আমার আবার চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে হাসান চৌধুরীর জানাজায় যেতে হবে, আমি যাই।”

হাসান চৌধুরী পাশের গ্রামের প্রভাবশালী লোক। তিনিও আজকে মারা গিয়েছেন। তাই মেম্বার সাহেব তার জানাযায় যেতে চাইলেন।

আমি তার কথা শুনে মনে মনে বললাম, নীরু মামা গরিব বলেই তাঁর প্রতিবেশী হয়েও মেম্বার তাঁকে রেখে আরেক গ্রামে চৌধুরীকে দাফন করতে চলে গেল।

নীরু মামার মৃত্যুর খবর জানানোর জন্য কোনো মাইকেরও ব্যবস্থা হয়নি। স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন হাসান চৌধুরী সাহেবের জানাজা থেকে ফেরার পথে নীরুকে জানাজা দিয়ে যাবেন।

হারুন মামাদের পুরোনো গোরস্তানের কাছে গিয়ে দেখলাম দুজন লোক জঙ্গল পরিষ্কার করছে।


একজন বৃদ্ধ লোক তাদেরকে বললেন- “আরে ঐ খানে না, ঐখানে হারুনের দাদার কবর, ঐ গাছটার গোড়া থেকে তিন ফুট বাদ দিয়ে মাটি খোর।”

তারা তাই করল। সেখানে একটি কবরও বাঁধানো নেই। কেউ বাঁধাবে তারও কোনো লক্ষণ নেই।

আমি দাদাকে খবর দিতে চাইলে হারুন মামা বাধা দিয়ে বললেন, ‘খবর পেলে চাচা চলে আসবেন, চৌধুরী সাহেবের জানাজায় উনি না গেলে তোমাদের বদনাম হবে। তাকে জানানোর দরকার নেই। জানাজা হলেই আমরা ঢাকায় ফিরে যাব।’


হারুন মামার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। নিজের ভাইয়ের সৎকারের মুহূর্তেও আমাদের সুনাম বদনামের ভাবনা তার মাথা থেকে যায়নি। তবু আমি তার কথার উপর আর কথা বলতে পারলাম না। তার কথামতো সেদিনই জানাজা সম্পন্ন করে আমারা ঢাকা চলে এলাম। এই শিক্ষনীয় কষ্টের গল্প আমার জীবনে অনুপ্রেরনাদায়ক হয়ে থাকবে।

Check Also

শিক্ষনীয় হাসির গল্প দুলাইভাইর ইউটিউবিং | কমেডি হাসির গল্প

দুলাভাই রসিক মানুষ। সংসারি নয়। আমার মতে তিনি অ্যাকসিডেন্টাল বিয়ের শিকার। যখন যেটা মাথায় আসে, একচোট এক্সপেরিমেন্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *